তাহাজ্জুদ (تهجد) অর্থ ঘুম থেকে জাগা । তাহাজ্জুদ নামাজ বা রাতের নামাজ হচ্ছে একটি নফল ইবাদত, ফরয নামাজের পর অন্যান্য সুন্নাত ও নফল সব নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ফযীলত সবচেয়ে বেশী ।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকেন নি। তবে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এটা সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ এ নামাজ আদায় করলে অশেষ পুণ্য লাভ করা যায়, কিন্তু আদায় করতে না পারলে কোনো গুনাহ হবে না।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার নিয়ম:
তাহাজ্জুদ একটি নফল ইবাদত । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাহাজ্জুদ নামাজ দুই রাকাত দুই রাকাত করে আদায় করতেন । তিনি কখনো ৪ রাকাত, কখনো ৮ রাকাত এবং কখনো ১২ রাকাত পড়েছিলেন । কিন্তু কেউ যদি এ নামাজ ২ রাকাত আদায় করেন, তাহলেও তার তাহাজ্জুদ আদায় হবে ।
যে কোনো সুরা দিয়েই এ নামাজ পড়া যায়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও সেজদা সহকারে একান্ত নিবিষ্ট মনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন ।
নিয়মঃ তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বাঁধা ।
অতঃপর ছানা পড়া, সুরা ফাতেহা পড়া, সুরা মিলানো তথা কেরাত পড়া । তারপর অন্যান্য নামাজের মতো রুকু, সেজদা আদায় করা ।
এভাবেই দ্বিতীয় রাকাআত আদায় করে তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা ।
তাহাজ্জুদ নামাযের নিয়তঃ
نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ رَكَعَتِى التَّهَجُّدِ – اَللهُ اَكْبَر
অর্থ: দুই রাকাআত তাহাজ্জুদের নিয়ত করছি…
অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বেঁধে নামাজ পড়া।
তাহাজ্জুদ নামাযের সময়ঃ তাহাজ্জুদ নামাজ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পড়া উত্তম । তাহাজ্জুদের মুল সময় মুলত রাত ২টা থেকে শুরু হয়ে ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত থাকে । তবে ঘুম থেকে না জাগার সম্ভাবনা থাকলে এশার নামাজের পর দুই রাকাত সুন্নত ও বিতরের আগে তা পড়ে নেয়া জায়েজ আছে ।
তাহাজ্জুদ নামাযের ওয়াক্তঃ ইশার নামাজ আদায়ের পর থেকে সুবহে সাদেকের আগ পর্যন্ত সালাতুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায় । কুরআনে রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের যে তাকীদ করা হয়েছে তার মর্ম এই যে, রাতের কিছু অংশ ঘুমিয়ে থাকার পর উঠে নামায পড়া । তাহাজ্জুদের সর্বোত্তম সময় এই যে, এশার নামাযের পর লোকেরা ঘুমাবে । তারপর অর্ধেক রাতের পর উঠে নামায পড়বে । নবী (সাঃ) কখনো মধ্য রাতে, কখনো তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পড়তেন । তারপর মেসওয়াক ও অযু করে নামায পড়তেন ।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের জন্য ওঠে কুরআনের এ আয়াতসহ সুরা আল-ইমরানের শেষ পর্যন্ত পড়তেন। – (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ – رَبَّنَا إِنَّكَ مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ – رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلإِيمَانِ أَنْ آمِنُواْ بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الأبْرَارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাত্বিলান, সুবহানাকা ফাক্বিনা ‘আজাবান্নার। রাব্বানা ইন্নাকা মাং তুদখিলিন্নারা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু, ওয়া মা লিজজ্বালিমিনা মিন্ আংছার। রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদিআই ইউনাদি লিল ইমানি আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফাআমান্না; রাব্বানা ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্ফির আন্না সাইয়্যেআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআ’ল আবরার।’
অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। পবিত্রতা তোমারই জন্য। আমাদেরকে তুমি জাহানড়বামের শাস্তি থেকে বাঁচাও। হে প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি যাকে জাহানড়বামে নিক্ষেপ কর তাকে অপমানিত কর। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান আনার জন্য একজন আহবানকারীকে আহবান করতে শুনে ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সকল গোনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেক লোকদের সঙ্গে আমাদের মৃত্যু দাও।’
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশে যখন দাঁড়াতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন:-
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ، لَكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ،
وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ، وَوَعْدُكَ الْحَقُّ، وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ، وَقَوْلُكَ حَقٌّ، وَالْجَنَّةُ حَقٌّ، وَالنَّارُ حَقٌّ،
وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ، وَمُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم حَقٌّ، وَالسَّاعَةُ حَقٌّ، اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ، وَبِكَ خَاصَمْتُ، وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ، فَاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ، وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ـ أَوْ لاَ إِلَهَ غَيْرُكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আংতা কায়্যিমুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না ওয়া লাকালহামদু। লাকা মুলকুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না। ওয়া লাকাল হামদু আংতা নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আংতাল হাক্কু। ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু। ওয়া লিক্বাউকা হাক্কু। ওয়াল ঝান্নাতু হাক্কু। ওয়ান নারু হাক্কু। ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কু। ওয়া মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হাক্কু। ওয়াস সাআতু হাক্কু। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়াবিকা আমাংতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু। ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু। আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতাল মুআখ্খিরু। লা ইলাহা ইল্লা আংতা। লা ইলাহা গাইরুকা।’ (বুখারি)
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! সব প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমান-জমিন ও উভয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আসমান-জমিন এবং এর মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের নুর। আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনি আসমান-জমিনের মালিক, আপনারই জন্য সব প্রশংসা। আপনিই চির সত্য। আপনার ওয়াদা চির সত্য। (পরকালে) আপনার সাক্ষাৎ সত্য। আপনার বাণী সত্য। আপনার জান্নাত সত্য। আপনার জাহান্নাম সত্য। আপনার (প্রেরিত) নবিগণ সত্য। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য, কেয়ামত সত্য।
হে আল্লাহ! আপনার কাছেই আমি আত্মসমর্পণ করলাম, আপনার ওপর ঈমান আনলাম, আপনার ওপরই ভরসা করলাম, আপনার দিকেই রুজু করলাম, আপনার (সন্তুষ্টির জন্যই) শত্রুতায় লিপ্ত হলাম, আপনাকেই বিচারক মেনে নিলাম। তাই আপনি আমার আগের-পরের প্রকাশ্য ও গোপন সব পাপ/অপরাধ ক্ষমা করুন। আপনিই শুরু এবং আপনিই শেষ মালিক। আপনি ব্যতিত সত্য কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই অথবা আপনি ব্যতিত (ইবাদতের উপযুক্ত) অন্য কেউ নেই।’
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার গুরুত্ব ও ফযীলতঃ
পবিত্র কুরআনে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য বিশেষভাবে তাগিদ করা হয়েছে ।