তাসের ঘরে তুমি আমি – পর্ব ০১

পর্ব 01

– আয়াশ রহমান

৫ মাস পর সুস্থ হয়ে বিদেশ থেকে ফিরে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলো শান।

আজকে দেশে ফিরবে সে কাউকে বলেনি। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। কলিং বেল দিতে যাবে তখন ভাবছে কিছুক্ষন পর তাকে সুস্থ দেখে কিরকম রিয়াকশন দেবে সবাই! তখনই দেখলো তাদের বাড়ির রাস্তার মোরের পাশে একটি গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে নামলো পুতুল, শানের প্রিয়তমা স্ত্রী। কিন্তু নামার আগেই একজন হাত ধরে ফেললো গাড়ির ভিতর থেকেই। পুতুলের হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল, আবার কালকে দেখা হবে। মিস করবো তোমায়।’ পুতুল বিনিময়ে মুচকি হাসলো। শান যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখের পাশ দিয়ে বের হল দুই ফোটা জল।

——-

সুখের সংসার ছিল শানের। বাবা মা, তার স্ত্রী পুতুলকে নিয়ে মধুবিত্ত একটি পরিবার ছিল তার। ছোট কোম্পানিতে একটি চাকুরি করত সে। তারপরও সুখের কোনো অভাব ছিলো না।

কিন্তু সব হারিয়ে গেলো এক কালো ঝড়ে। হঠাৎ অফিস থেকে আসার সময় একদিন এক্সিডেন্টে চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে বসে সে।

চেতনা ফিরে পেলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে শান। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে সবকিছু অন্ধকার দেখতে পেলে তার পরিবার তাকে জানায় এক্সিডেন্টে মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগায় সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে।
সেদিন শানের পাশে বসে পুতুল অনেক কেদেছিল। তবুও শানকে এক মুহুর্ত ছেড়ে যায়নি।

বাবা মার পছন্দে পুতুলকে বিয়ে করেছিলো শান। বিয়ের পর হাসি কান্না আনন্দ অভিমানে ভালই চলছিলো পুতুলের সাথে তার জীবন। শান বারবার বুঝেছে বাবা মা তার জন্য সবচেয়ে ভাল কাউকেই বেছে এনেছে।
সেদিনও এক্সিডেন্টের পর সেটাই প্রমাণ হল। পুতুলের সেবা যত্নে মাথার চোট ধীরে ধীরে সারলো। কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা শানকে ঘিরে ধরল।

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শান। এখন কিভাবে তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার চলবে? শান কতদিন যে পুতুলকে বলেছে,
‘পুতুল আমি বলি কি তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও, ভালো থাকবে।’
‘এই কথা দ্বিতীয় বার আর বলো না। আজ আমার যদি কিছু হত, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে?’
‘কি বলছো এসব?’
‘যেতে না তো! তাহলে আমি কিভাবে যাই? তোমাকে এই অবস্থায় রেখে আমি একা ভালো থাকবো?’
‘পুতুল তুমি তো জানো কি অবস্থা পরিবারের, টাকা পয়সা প্রায় শেষের পথে,,,’
‘জানি আমি বলি কি, না হয় আমি একটা জব নেই।’
‘কিন্তু…
‘কোনো কিন্তু না, আমি কি আমার পরিবারের জন্য এটুকু করতে পারি না? তারপর তুমি সুস্থ হলে আমি না হয় আবার জব ছেড়ে দিলাম।’
‘হাহা, আমি আবার সুস্থ!!!’
‘দেখো তুমি আবার দেখতে পাবে, আমরা তো কালকেই ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। দেখি না কি বলে ডাক্তার।’
শান চুপ করে রইল।

পরের দিন হাসপাতালে ডাক্তার বলল শানের চিকিৎসা হতে হলে সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে হবে আর এটা খুব ব্যয়বহুল চিকিৎসা।
পুতুল আর শান দুজনের মুখই বিমর্ষ হয়ে রইল। শেষে পুতুল ডিসিশন নিল, এখন তো চিকিৎসার টাকাও নেই তাদের কাছে, তাই পুতুল চাকুরি করে টাকা জমিয়ে তারপর না হয় কয়দিন পর শানের চিকিৎসা করাবে।
শান সেদিন বুঝেছিল স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনের পরিপূরক।

কয়দিন পর পুতুল একটা এনজিও তে চাকুরি নিল। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই কাটছিল তাদের। অল্প বেতনের মাঝেও অনেক টাকা করে সেভ করছিল তারা শানের চিকিৎসার জন্য। পুতুক অফিস শেষে এসেই শানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তার খুব যত্ন করতো।
শান মাঝে মাঝে বলতো, ‘আমি যদি অন্ধ হয়েও থাকি তাও আমার কোনো অভিযোগ নেই, কারণ এরকম আদর পাব, তোমার কাছে সারাটা জীবন।এই আদর ভালোবাসা দিয়েই আমি একটা জীবন কাটাতে পারব।’
বিনিময়ে পুতুলের মব মাতানো হাসির আওয়াজ শুনতো সে।
শানের মা কাথা সেলাই করে বিক্রি করতো কম দামে, এ টাকা দিয়েও কিছু সংসারের খরচ মিটতো।

কিন্তু হটাৎ কয়দিন পর পুতুল কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেলো। রাতে ফিরতো, মাঝে মাঝে ১১ টা ১২ টাও বেজে যেত। শান কিছু বললে বলত অভারটাইম করছে সে। টাকাও জমাতে পারছিলো না আর অভার টাইম করেও। শানের বাবা মা বললে বলত ঃএত রাতে হেটে না এসে সি এন জি তে আসি, তাই একটু খরচ বেশি হয়। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই যখন ওভারটাইমের টাকা পাব তখন আর সমস্যা হবে না।’

কিন্তু পুতুলের আর সেই কিছুদিন আসলো না। শানের উপরও কেমন যেন পুতুলের যত্ন আদি কমে যাচ্ছিল। অফিস থেকে দেরি করে ফিরেই সে শানকে ক্লান্ততা দেখিয়ে শুয়ে পড়ত। কত রাত যে শান নিদ্রাহীন কাটিয়েছে তার ঠিক নেই। কিন্তু মনকে শান্তনা দিত পুতুল তো এসব তার জন্য তার পরিবারের জন্যই করছে।

শানের বাবা মা বৃদ্ধ হলেও বেশ বুঝেছিলো পুতুলের আশায় থাকলে ছেলের চিকিৎসা হবে না। একদিন তারা শানকে এসে বলল,
‘বাবা আমরা কালকে তো ভিসা পাসপোর্ট করাতে যাব। সামনের মাসেই তুই যাবি চিকিৎসার জন্য।’

‘কিন্তু বাবা এত টাকা তুমি কোথায় পেলে?’
‘তোর নানু মারা যাওয়ার আগে তোর মায়ের নামে কিছু জমি লিখে দিয়েছিল। সেটাই আজ বিক্রি করে এসেছি।’
‘কিন্তু মায়ের সম্পদ এভাবে,,,’ বলার আগেই পাশ থেকে শানের মা বলল,
‘আমার সম্পদ তো তুই। তোকে ছাড়া কিভাবে চলব আমরা?’
পুতুল বাসায় এলে তাকে জানালেও সে কিছু বললো না তেমন। শুধু বললো, ‘বেশ ভালোই। তুমি জলদি যাও।’
‘তোমাকে ছাড়া কিভাবে যাব আমি?’
‘আরেহ আমি গেলে কেমন হবে? তাহলে চাকুরী করব কিভাবে আর পরিবারের খরচ মিটাব কিভাবে?’
‘হ্যা ঠিকই বলেছো।’

বিদেশে আসলো শান। এয়ারপোর্ট অব্দি সে পুতুলের হাতখানা ধরে ছিলো। পুতুল সাহস জুগিয়েছিলো তাকে। বাবা মা সবার থেকে বিদায় নিয়ে সে বিদেশে এসেছিলো চিকিৎসা করাতে।

আজ পাচ মাস পর সে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরছে। ভিতরে কথা হয়েছে পুতুলের সাথে বাবা মার সাথে ফোনে কিন্তু শান বলেনি সে সুস্থ হয়ে গেছে। ভেবেছে সামনা সামনি সারপ্রাইজ দেবে৷ কিন্তু কে জানতো আজ নিজেই এত বড় কিছুর সম্মুখীন হবে।

এসব দেখে শান ভাবছে কেন সে ঠিক হল!অপারেশনের সময় সে মারা গেলো না কেনো? ভাবতে ভাবতেই পুতুল সামনে এসে দাড়িয়েছে।
‘তুমি?’
একবার পুতুলের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সড়িয়েছে শান।
কি মনে করে পকেট থেকে ফোল্ডিং লাঠি টা বের করলো সে, আর সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে নিল।
লাঠি ঝাকাতে ঝাকাতে চারপাশে হাত আওড়াতে আওড়াতে বলল,
‘পুতুল না? পুতুলের আওয়াজ মনে হল৷ পুতুল, কোথায় তুমি পুতুল??’

চলবে…

115 Views
Share this Post :
Jahid Farahan
Jahid Farahan

Life style travel filmmaker.

Articles: 332
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments